ক্ষমতা ধরে রাখতে হাসিনা সরকার সহিংস হয়ে ওঠে:


ঢাকা: জুলাই আন্দোলন কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও এর মূল কারণ ছিল আরও গভীরে— ধ্বংসাত্মক, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার ফলে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক বৈষম্য। ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার এই আন্দোলন দমন করতে সহিংস পন্থা অবলম্বন করেছিল।


অভ্যুত্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।


সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক উদ্বোধনী বক্তব্য  দেন। প্যানেল সদস্য হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ররি মাঙ্গোভেন, মানবাধিকার কর্মকর্তা জ্যোৎস্না পৌদ্যাল ও প্রধান মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি ।


ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী লীগ সরকার, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সহিংস গোষ্ঠীগুলো গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন চলাকালীন ধারাবাহিকভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল।


উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিক্ষোভকারী এবং তাদের সমর্থকদের ওপর আক্রমণ ও সহিংস দমন-পীড়নের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। এতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা জরুরি ভিত্তিতে আরও তদন্তের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।


বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়ে থাকতে পারেন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, যাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আহত হন। নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ জানায়, ওই সহিংসতায় তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা প্রাণ হারান।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল উচ্চ আদালতের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। তবে এর মূল কারণ ছিল আরও গভীরে—ধ্বংসাত্মক, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার ফলে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক বৈষম্য। ক্ষমতা ধরে রাখতে আওয়ামী সরকার এই বিক্ষোভ দমন করতে ধারাবাহিকভাবে আরও সহিংস পন্থা অবলম্বন করেছিল।


‘গণবিরোধিতার মুখে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সাবেক সরকার সচেতনভাবে পরিকল্পিত ও সমন্বিত কৌশল হিসেবে এই নৃশংস দমননীতি গ্রহণ করেছিল,’ বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক।  


তিনি আরও বলেন, ‘বিক্ষোভ দমন কৌশলের অংশ হিসেবে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা, ব্যাপকভাবে নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে—এবং তা রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় পরিচালিত হয়েছে বলে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। ’


‘আমাদের সংগ্রহ করা সাক্ষ্য ও প্রমাণ ভয়াবহ একটি চিত্র তুলে ধরে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু করে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম গুরুতর উদাহরণ, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবেও গণ্য হতে পারে,’ যোগ করেন ভলকার তুর্ক। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ’


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে একটি দল পাঠায়। এই দলে মানবাধিকার তদন্তকারী, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক এবং একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা প্রাণঘাতী এসব ঘটনার ওপর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান পরিচালনা করেন।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তদন্ত প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করেছে, প্রয়োজনীয় প্রবেশাধিকারের অনুমতি দিয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ প্রাসঙ্গিক নথিপত্র সরবরাহ করেছে।


সরাসরি বিক্ষোভ দমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও শীর্ষ কর্মকর্তারা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে পরিচালনা  করেন এবং তাদের পর্যবেক্ষণ করেন। এই বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছে অথবা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছে।


প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধ উপায়ে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করে দেওয়ার কৌশল নেয়। এমনকি কিছু ঘটনায় লোকজনকে খুব কাছ থেকে গুলি করার প্রমাণও পাওয়া যায়।


প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি ঘটনার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যার মধ্যে আবু সাঈদের ঘটনাটি অন্যতম। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিক্ষোভ চলাকালে তিনি পুলিশের উদ্দেশে হাত প্রসারিত করে বলেন, ‘আমাকে গুলি করো। ’ ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র এবং ভূ-অবস্থান প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তদন্তকারীরা তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল, তা সাক্ষ্য প্রমাণের জন্য পুনঃনির্মাণ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে এর মিল পাওয়া গেছে।


ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আবু সাঈদকে কমপক্ষে দুইবার শটগানের ধাতব গুলি দিয়ে প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে গুলি করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আবু সাঈদ পুলিশের পরিকল্পিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।


প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া নারীসহ অনেক নারী নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের শিকার হন। নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন তারা।


প্রতিবেদনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বেশ কয়েকটি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে শারীরিক আক্রমণ ও ধর্ষণের হুমকি অন্তর্ভুক্ত। এসব হামলার উদ্দেশ্য ছিল নারীদের বিক্ষোভে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা।


প্রতিবেদনটি এও খুঁজে পেয়েছে যে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের হত্যা ও পঙ্গু করেছে, এবং তাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অমানবিক অবস্থায় আটক এবং অত্যাচারের শিকার করেছে। নথিভুক্ত মৃত্যুর ঘটনাগুলোর একটি এমন ছিল, যেখানে ধানমন্ডিতে ১২ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী গুলিতে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারনে মারা যান। প্রায় ২০০টি ধাতব গুলি ছোড়া হয়েছিল সেখানে।


এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে ছিল খুব ছোট শিশু যাদের বাবা-মায়েরা তাদের বিক্ষোভে নিয়ে গিয়েছিলেন অথবা যারা পথচারী হিসেবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জে এমন একটি ঘটনা রয়েছে। সেখানে ছয় বছর বয়সী এক মেয়ে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সংঘর্ষ দেখছিল। এ সময় তার মাথায় গুলি করা হয়।  


৫ আগস্ট— বিক্ষোভের শেষ এবং সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিনের একটিতে আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে বলছিল, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। ’ সে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল বলে জানিয়েছে।


প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী আহত বিক্ষোভকারীদের জরুরি চিকিৎসা সেবা পেতে বাধা দিয়েছিল বা তা থেকে বঞ্চিত করেছিল। তারা হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে এবং চিকিৎসাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখায়।  


এ ছাড়া যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ জব্দ করে, যা বিক্ষোভকারীদের শনাক্ত করা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংসতার প্রমাণ লুকানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত সরকার দেশের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্য করে প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং গুরুতর সহিংসতাও চালানো হয়। হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর আদিবাসী জনগণও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।  


যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় ১০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, তবে অনেক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং এসব গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পরেও অপরাধীরা এখনো দায়মুক্তিতে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।


প্রতিবেদনটি কিছু বিস্তারিত পরিসরে সুপারিশ  দিয়েছে, যেমন নিরাপত্তা ও বিচার খাতের সংস্কার, নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখার জন্য প্রণীত দমনমূলক আইন ও প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় বৃহত্তর পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা।


‘বাংলাদেশের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ হলো এই সময়কালে সংঘটিত ভয়াবহ অন্যায়ের স্বীকারোক্তি, পুনর্মিলন ও জবাবদিহির মাধ্যমে সত্য উদঘাটনের একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া হাতে নেওয়া,’ বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান।


তিনি আরও বলেন, ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ঐতিহ্যকে সংশোধন করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর কখনো না ঘটে। আমার দপ্তর এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় জবাবদিহি ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে প্রস্তুত। ’


বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫

টিএ/আরএইচ

 



Tags:

We will be happy to hear your thoughts

Leave a reply

Daily Deals
Logo
Shopping cart