ঢাকা: মুর্শিকুল ইসলাম শিমুল রাজধানীর পল্টন এলাকায় বসবাস করেন। একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন।
শারীরিক সমস্যার জন্য নিয়মিতই তাকে ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ (কিউ১০, কারভা, রোভাস্ট, বেটালক, কোরালক্যাল-ডি) কিনতে হয়। তবে সম্প্রতি ওষুধ কিনতে গিয়ে দেখলেন, দাম অনেক বেড়ে গেছে। ওষুধের বাড়তি খরচ যোগাতে গিয়ে মাসের হিসাবে কাটছাঁট করার পরিকল্পনা করতে হচ্ছে তাকে।
‘আগে ওষুধ কিনতে সপ্তাহে আমার ৮০০ টাকার মতো লাগতো। এখন সেই ওষুধ কিনতেই আমার প্রায় এক হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অথচ আমার আয় কিন্তু এক টাকাও বাড়েনি। ওষুধের জন্য বাড়তি এই ব্যয় আমার জন্য এবং আমার মতো অনেকেরই যাদের সীমিত আয়, তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে’ বলছিলেন মুর্শিকুল ইসলাম শিমুল।
রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় কথা হয় ফয়সাল চৌধুরী নামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে। ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে তার ওপরও। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ উচ্চমূল্যে ওষুধ কিনে খেতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে দেখার কেউ নেই। ওষুধ কোম্পানির দিকে একটু নজর দিন। ওষুধের উচ্চমূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে কমিয়ে আনার অনুরোধ জানাই। ’
ব্যবহারকারী ও ক্রেতারা ওষুধের বাড়তি দামের অভিযোগ তুললেও সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, দাম বাড়েনি। তিন মাস আগে নতুন পরিচালক যোগ দিয়েছেন। এই সময়ে তিনি দাম বাড়াননি এবং সমন্বয়ও করেননি। এর আগেও বাড়ানো হয়নি, তবে কোনো কোনো কোম্পানির ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
এমনিতেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি টানা ১০ মাস ধরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব বলছে, জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২৪ সালের মার্চের পর খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই পরিস্থিতির মধ্যেই বাড়তি দামে ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাওয়ার কথা বলছেন ক্রেতারা।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যক্তি নিজেই বহন করেন। এ ব্যয় করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসার মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬৫ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে ওষুধ কিনতে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩০৮টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তৈরি করে আসছে। দেশে দেড় হাজারেরও বেশি জরুরি ওষুধের ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন হয়। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ওষুধ রয়েছে ২১৯টি। এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলোই।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়েছেন বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক। তিনি জানতে পেরেছেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ করেই প্রায় অর্ধশত জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি। অন্যান্য ওষুধের দাম ৩০ থেকে প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে।
ফার্মেসি সংশ্লিষ্টরা বেশ কয়েকটি ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে অ্যাকমি কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক এজিন ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের প্রতিটিতে দাম বেড়েছে ২০ টাকা। ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির ওএমজি ৩০০ ক্যাপসুলের প্রতিটির দাম ৪০ টাকা বেড়েছে।
অ্যাকমির ডিডিআর ৩০ মিলিগ্রামের প্রতি পাতায় বেড়েছে ১৫ টাকা। বেক্সিমকোর উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এমডাকল ৫ মিলিগ্রামের দাম ৭৩ টাকা থেকে বেড়ে ৮২ টাকা হয়েছে। নাপা সিরাপ ২০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, স্কয়ারের ইভিট ৪০০ মিলিগ্রাম ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা হয়েছে।
অ্যাকমি কোম্পানির মোনাস ১০ এক (৩০ পিস) বক্সের দাম আগে ছিল ৪৮০ টাকা, এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৫২৫ টাকা। স্কয়ারের এনাফ্লেক্স ম্যাক্স ৫০০ মিলিগ্রামের ১৩০ টাকার বক্সের বর্তমান দাম ২১০ টাকা। স্কয়ারের অ্যানাডল এস আর ১০০ মিলিগ্রাম ১২০ টাকা থেকে দাম বেড়ে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এসিআই কোম্পানির টেট্রাসল ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকা, ইনসেপ্টার এলিমেট প্লাস লোশন ১১০ টাকা থেকে ২০০ টাকা, স্কয়ারের রসুভা ১০ মিলিগ্রাম ২০০ টাকা থেকে দাম বেড়ে ২২০ টাকা হয়েছে।
বেক্সিমকোর রসুটিন ১০ মিলিগ্রামের প্রতি বক্সে দাম বেড়েছে ৬০ টাকা। স্কয়ারের এসিন্টা ম্যাক্স ২০০ এমএলের বোতল ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা, অ্যারিস্টোফার্মার অ্যাভোল্যাক সিরাপ ১০০ এমএল বোতলের দাম ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা এবং ২০০ এমএল বোতল ২৪০ থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ওষুধ প্রযুক্তিবিদ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ওষুধের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ওষুধের কাঁচামাল, লেবেল, মোড়ক সামগ্রী, মার্কেটিং খরচ ও ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে এবং কোম্পানিগুলো ঔষধ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে, কিংবা ভুল বুঝিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো ওষুধের দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে।
ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওষুধের দাম বাড়াতে হলে জাতীয় কমিটির মিটিং করতে হয়। মিটিং করে দাম বাড়াতে হয়। সেরকম কোনো মিটিং হয়েছে বলেও আমরা শুনিনি। এর অর্থ হলো কোনো একটি চক্র খেয়ালখুশি মতো ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ’
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর বড় সংখ্যক মানুষ চিকিৎসাব্যয় বহন করতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। ওষুধের দাম বাড়ার ফলে এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে। অন্যদিকে ওষুধের দাম বাড়ার ফলে নিম্নবিত্ত একটি অংশ ওষুধ কিনতে পারবে না, এতে তাদের অসুস্থতা দীর্ঘায়িত হবে। অনেকেই ওষুধ কিনতে গিয়ে খাবারের গুণগত মান কমিয়ে দেবে, এতে পুষ্টিহীনতা বাড়বে। পুষ্টিহীনতা তৈরি হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যাবে। ’
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ওষুদের উৎপাদন খরচ বাড়লেও তা নিশ্চয়ই ৫০ কিংবা ৭০ শতাংশ বাড়েনি। কিন্তু কিছু ওষুধের দাম তার চেয়েও বেশি বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাব্বির হায়দার বাংলানিউজকে বলেন, ‘জীবন রক্ষাকারী যে ওষুধগুলোর দাম ঔষধ প্রশাসন নির্ধারণ করে দেয়, সেগুলোর দাম মোটামুটি যৌক্তিক। এর বাইরে কিছু ওষুধের দাম বেশি মনে হয়। কারণ এসব ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, কোম্পানিই এসব ওষুধের দাম নির্ধারণ করে। অনেক কোম্পানি আছে, তাদের ওষুধের দাম এমনিতেই অনেক বেশি রাখে। ’
‘ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো গড়ে ৫০ শতাংশের কম-বেশি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করে থাকে। ওষুধ কোম্পানির প্রফিট মার্জিন বাজারে অন্যান্য পণ্যের থেকে অনেক অনেক বেশি। ’
ওষুধের বাড়তি দামে যখন দিশেহারা নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ, তখন ওষুধ শিল্প সমিতিও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সুরে বলছে, একটি ওষুধেরও দাম বাড়ানো হয়নি।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর হলো, নতুন ডিজি (ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) আসার পর, কিংবা আগে যে ডিজি ছিলেন, সেই সময়ে একটি ওষুধেরও দাম বাড়েনি। বাজারে যদি দাম বেড়ে থাকে তাহলে অন্যভাবে বেড়েছে। ’
বাংলানিউজের এই প্রতিবেদক তিনি বলেন, ‘আপনি লিখে দিন, ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব বলেছেন, একটি ওষুধের দামও বাড়েনি। আপনারা যেটি শুনেছেন, তা সঠিক নয়। একটি ওষুধের দামও বাড়েনি। ’
ফার্মেসি থেকে পাওয়া ওষুধের দাম বৃদ্ধির চিত্র তার সামনে তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘দুই, তিন মাস কিংবা ছয় মাসেও কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি। আপনি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোনো ওষুধের দাম বাড়েনি। ’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক এবং মুখপাত্র ড. মো. আকতার হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি অল্প কয়েকদিন হলো দায়িত্ব পেয়েছি, তাতে দেখলাম গত পাঁচ ছয় মাসে ওষুধের দাম বাড়ানোর কোনো বিষয় নেই। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের পরিচালক আশরাফ হোসেন ভালো বলতে পারবেন। ’
অধিদপ্তরের মুখপাত্রের কথার সূত্র ধরে পরিচালক আশরাফ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নতুন স্যার (মহাপরিচালক) তিন মাস হলো এসেছেন, এই সময়ে নতুন স্যার কোনো দাম বাড়াননি এবং সমন্বয়ও করেননি। তার আগেও বাড়ানো হয়নি, তবে কোন কোন কোম্পানির দাম সমন্বয় করা হয়েছে। ’
কীভাবে সমন্বয় করা হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেমন এক কোম্পানির কোনো ওষুধের দাম আট টাকা, আবার অন্য কোম্পানির একই ওষুধ ১২ টাকা। এক্ষেত্রে কিছু দাম সমন্বয় করা হয়েছে। গত ছয় মাস কিংবা এক বছর যাই বলুন না কেন, ম্যাক্সিমাম প্রাইস থেকে বেশি কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৭০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৫
আরকেআর/আরএইচ